একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদকের সন্ধানে আওয়ামী লীগ

সৈয়দ বোরহান কবীর : আওয়ামী লীগ আগামী কাউন্সিল অধিবেশনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে। ২৪ ডিসেম্বর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম এ রাজনৈতিক দলটির কাউন্সিল হবে। আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের যে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলনের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হয়, সেই বৈঠকে দলটির সভানেত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের কাউন্সিল হবে অনাড়ম্বর। এক দিনের। জাঁকজমকবর্জিত। প্রায় ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির কাউন্সিল হওয়ার কথা ব্যাপক ঘটা করে। উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু তা না করে কেন এরকম সীমিত আয়োজনের নির্দেশনা? এর কারণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশে ক্রমে ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ আগামী বছর সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছে। বলা হচ্ছে, ২০২৩ হবে দুর্ভিক্ষের বছর। ২০২০ সাল থেকেই বিশ্ব নানা সংকটে টালমাটাল। করোনা গোটা বিশ্বকে গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রায় নয় মাস ধরে চলছে এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইউরোপকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। আমাদের অর্থনীতির শক্তি এবং সামর্থ্যরে জায়গাগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রবাসী আয়ে কোনো সুখবর নেই। আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে অক্টোবরে। রপ্তানি আয়েও সুখবর নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সংকট শিল্পোৎপাদনকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। একমাত্র কৃষি ছাড়া কোথাও কোনো সুখবর নেই। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। চিহ্নিত অর্থ পাচারকারী, লুণ্ঠনকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। এত সংকটের মধ্যেও দুর্নীতি কমেনি। আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকটের কথা বলছেন। দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। বুধবার নবীন সরকারি কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। অনুরোধ করলেন কৃচ্ছ্রসাধনের। আহ্বান জানালেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না রাখার। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সংযম ও ব্যয় সংকোচের কথা বলছেন, তখন দুই আমলা শিরোমণির জন্য বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর অনৈতিক ও কুৎসিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। সেই প্রাসাদে সুইমিংপুলও থাকবে! দেশ যখন সংকটের উত্তাপে বিপন্ন তখন শিরোমণি আমলারা একটু সাঁতার বিনোদন করবেন না, তা কী করে হয়। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা আমলারা যখন নানা সুযোগ-সুবিধার থালা চেটেপুটে খাচ্ছেন, তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেবল বিএনপির সমালোচনার ভাঙা রেকর্ড অবিরত বাজিয়ে চলেছে। কিছু মন্ত্রী এবং নেতার বক্তব্য এখন গণবিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগে নানা জানা-অজানা রোগ বাসা বেঁধেছে। কিছু কিছু রোগ দুরারোগ্য ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদী হাইব্রিডরা যেন এখন আওয়ামী লীগকেই গ্রাস করে ফেলছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির কিছু ব্যক্তি যেন ভিনগ্রহ থেকে আসা এলিয়েন। এদের গাল সামান্য রোদে মাখনের মতো গলতে থাকে। তৃণমূলের বেশির ভাগ ত্যাগী-পরীক্ষিত কোণঠাসা। তাদের চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ। দলে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। কোন্দল, হানাহানি প্রায় সর্বত্র। টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি হচ্ছে। পদবাণিজ্য, কমিটি-বাণিজ্য আওয়ামী লীগে মহামারির আকার ধারণ করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলা পরিষদ সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ! এমপিদের অর্ধেকেরই এলাকার সঙ্গে সংশ্রব নেই। সারা দিন ব্যস্ত থাকেন নানা তদবিরে। চাকরি-বাণিজ্য, ত্রাণ নয়ছয়, কমিশন-বাণিজ্য এসব নিয়েই ব্যস্ত আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধেক সংসদ সদস্য। এরা যেন মনে করছেন, এবারই শেষ সুযোগ। যা বানানোর বানিয়ে নিই। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন সময়ের দাবি। দলের কয়েকজন নেতা নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব এড়াতে বিএনপিবিরোধী চটুল বক্তব্য রাখাটাই একমাত্র কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের কথার দাপটে মৃতপ্রায় বিএনপিও এখন জেগে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন সংকটের কথা বলছেন খোলামেলাভাবে, তখন কিছু মন্ত্রী সংকট আড়ালের লুকোচুরি খেলায় মেতেছেন। সবকিছু মিলিয়ে দল এবং সরকার কোনোটাই ভালো নেই। ২০০৯ সালে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ সময় বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সে উন্নয়নই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এক বছরের কিছু বেশি সময় আছে সংসদ নির্বাচনের। এর মধ্যে নানা অস্বস্তি, সমালোচনায় এলোমেলো আওয়ামী লীগ। এ রকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ তার জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

 

১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে। সেই কাউন্সিলে দল রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে নেতা নির্বাচিত করার কোনো বিকল্প ছিল না। সেই থেকে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। এ মুহূর্তেও তাঁর কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা একাই দলের হাল ধরে আছেন। একাই সব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এ দলটি মুমূর্ষু। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘একজন কাউন্সিলরও যদি না চায় তাহলে আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকব না।’ কাউন্সিলর তো দূরের কথা। একজন কর্মীও শেখ হাসিনার বিকল্পের কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। তাই আসন্ন কাউন্সিলে যে দলীয় প্রধান পদ নিয়ে কোনো আলোচনাই হবে না, তা বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আবেগ ও ভালোবাসা জড়িত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক যুগ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায়ই তিনি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে জনগণের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রথম সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। কারাগারে থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান নবগঠিত দলটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক অবশ্য সংগঠনের জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন দলটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের জাগরণের অধ্যায় শুরু হয়। মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতি শুরু থেকেই বাঙালির সমর্থন ও সহমর্মিতা ছিল। কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী করা, জনগণকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব যখনই কারাগারের বাইরে থেকেছেন, তখনই সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের প্রাণ ভোমরায় পরিণত হন তিনি। তরুণ সাহসীদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে এক উজ্জীবিত সংগঠনে পরিণত করেন। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্য হয়। কাগমারী সম্মেলনের পর মার্চে মওলানা ভাসানী দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে ভাসানীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। পদত্যাগ করলেও ভাসানীকেই আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বহাল রাখা হয়। কিন্তু এর কদিন পরই ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই ভাসানীর উদ্যোগে ঢাকায় গণতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে মুজিবের সংগঠন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। বন্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা। এ সভায় দল পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত হয়। তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিব হন সাধারণ সম্পাদক। এ ধারাবাহিকতায় মার্চের ৬ ও ৭ ঢাকার ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে তর্কবাগীশ সভাপতি হন। চতুর্থবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন ‘অসাধারণ’। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। বাঙালির স্বপ্নের সারথি। এর পরের ইতিহাস বাঙালির মুক্তির ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ’৭০-এর নির্বাচন। শেখ মুজিবই হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের আরেক নাম। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ছয় দফা অনুমোদিত হয়। ওই কাউন্সিলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর ও অসাধারণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন আরেক ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৬-এর ১৮ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন জনগণের নেতা। জনজাগরণের কাব্য। তাজউদ্দীন ছিলেন নিভৃত সংগঠক। গোছানো একজন নেতা। একজন জ্ঞানমনস্ক রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণতা দেওয়াই ছিল তাঁর আরাধ্য। ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন আরেক মহিরুহ এ এইচ এম কামারুজ্জামান। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের শেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৪ জুন। এ কাউন্সিলে দ্বিতীবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। আওয়ামী লীগের জন্য এ কাউন্সিল ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত নেতৃত্বই ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এনে দেন। এনে দেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ম্যান্ডেট। ’৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পরিকল্পনার নিখুঁত বাস্তবায়ন করেন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।

 

’৭০-এর ৪ জুনের কাউন্সিল যেমন আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবারের কাউন্সিলও তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছে। ’৭০-এর কাউন্সিলে তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে এক ঐতিহাসিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন তাজউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। তাজউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সংগঠনভাবনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায়। আমার বিবেচনায় ওই সময় যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্য কেউ হতেন তাহলে প্রবাসী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা অনেক দুরূহ হতো। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাঁরা সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তাঁরা সবাই ভালো নেতা। সদ্যপ্রয়াত বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। প্রত্যেকেই জাতীয় নেতা। আওয়ামী লীগের ত্যাগী সংগ্রামী নেতা। কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র দুজন ছাড়া কেউই ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠতে পারেননি। এদের কেউ কেউ সংকটে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেনে ক্ষুদ্র পরিসরে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। কিন্তু কাউন্সিল শুরুর আগেই আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। তীব্র কোন্দলের মুখে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ১০ দিনের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের। ১৯৭৮ সালের ৩ থেকে ৫ এপ্রিল সংকটাপন্ন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল করে। এ কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি হন। দক্ষ সংগঠক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় আবদুর রাজ্জাকের সামনে সুযোগ এসেছিল ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে ওঠার। কিন্তু সংকীর্ণ স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে যান আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুবিহীন আওয়ামী লীগ এক পথহারা বিভ্রান্ত বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। তৃণমূল থেকে আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে দরকার। এ সময় মুমূর্ষু আইসিইউতে থাকা আওয়ামী লীগকে বাঁচানোর আর কোনো বিকল্প ছিল না। ’৮১-এর কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয়। শেখ হাসিনা সভানেত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে জাগরণ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠনের সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধেন। ইতিহাসে অমর হওয়ার এক অনন্য সুযোগ এসেছিল দক্ষ সংগঠক আবদুর রাজ্জাকের সামনে। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারের পাশে বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে থাকার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছিলেন এই নেতা। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ, মাইম্যান নীতিতে আবদুর রাজ্জাক ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠতে পারেননি। শেখ হাসিনার পথ কঠিন করতে আবদুর রাজ্জাক উপদলীয় কোন্দলের পথে পা বাড়ান। তাঁর উদ্যোগে ১৯৮২ সালের ১ মে ছাত্রলীগ ভেঙে যায়। এ ধারায় আওয়ামী লীগ ভাঙনের মুখে পড়ে। ১৯৮৩ সালের ২২ অক্টোবর মহিউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করে বাকশাল গঠিত হয়। এ সময় আবার সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ক্রমে তিনি ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রমাণ করেন নেতার প্রতি বিশ্বস্ত, আদর্শের প্রতি অনুগত থাকলে সংগঠন গড়ে তোলা যায়। নেতার আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সাজেদা চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দুঃসময়ের কাণ্ডারি। ’৮৭ সালের কাউন্সিলে যখন তিনি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হন, তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পর জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৯২-এর ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে। তিনিও ছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক। ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন না জিল্লুর রহমান। কিন্তু নেতার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততায় অনুকরণীয় নেতা হয়ে থাকবেন চিরকাল। আবদুল জলিলও বিশ্বস্ত ছিলেন। দলীয় সভানেত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন। কর্মীদের খোঁজখবর নিতেন। সংগঠনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু কঠিন সময়ে সংকটে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের ধাক্কায় হতবিহ্বল জলিল রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেন। একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি আওয়ামী লীগের এই পোড় খাওয়া নেতা। আবার কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগে না থাকার পরও ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন সময়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য ‘মাইনাস ফরমুলা’ আবিষ্কার হয়। মাইনাস ফরমুলা বাস্তবায়নের জন্য গ্রেফতার করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে। ’৭০-এ বঙ্গবন্ধু যেমন তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও তেমনি গ্রেফতারের আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ রেখেছিলেন। প্রচারবিমুখ, কর্মীদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা সৈয়দ আশরাফ সংকটে ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সৈয়দ আশরাফ নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। খুব বেশি কথা বলতেন না। কিন্তু যখন কথা বলতেন যখন মূল্যবান কথাই বলতেন। প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে যা খুশি বয়ান দিয়ে নিজেকে খেলো করতেন না। তাঁর কথা জনগণ বিশ্বাস করত, পছন্দ করত। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় তার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কী শক্তিশালী, কী দৃঢ় সেই বক্তব্য। গোটা দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছিল ওই কথায়। সৈয়দ আশরাফ প্রমাণ করেছেন সাধারণ সম্পাদকের কাজ প্রতিদিন কাগজ দেখে একই কথা বারবার বলা নয়। সাধারণ সম্পাদককে বিশ্বস্ততার প্রতীক হতে হবে। তার কথাবার্তা হতে হবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এবার কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের চাওয়া একটাই- একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক। যিনি নেতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন। আদর্শে থাকবেন অবিচল। সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কর্মীদের সুখ-দুঃখ দেখবেন। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের পাশে দাঁড়াবেন। দলের কাজ করবেন দিনরাত। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এমন নেতা আওয়ামী লীগে আছে। সামনে কঠিন সময়। এ সময় এ রকম একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]     সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এসেছে: মাসুদ সাঈদী

» নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান

» অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ চারজন মাদক চোরা কারবারি আটক

» সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, যা জানালেন বদিউল আলম

» ২ মার্চ ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান মঈন খানের

» কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়: আইজিপি

» সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত! হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

» বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পট লোন পেলেন সিলেটের সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা

» ‘ইউসিবি নাইট’ আয়োজনে গ্রাহক ও অংশীদারদের অব্যাহত সহযোগিতার স্বীকৃতি

» ইসলামপুর ওয়ার্ড কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদকের সন্ধানে আওয়ামী লীগ

সৈয়দ বোরহান কবীর : আওয়ামী লীগ আগামী কাউন্সিল অধিবেশনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে। ২৪ ডিসেম্বর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম এ রাজনৈতিক দলটির কাউন্সিল হবে। আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের যে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলনের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হয়, সেই বৈঠকে দলটির সভানেত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের কাউন্সিল হবে অনাড়ম্বর। এক দিনের। জাঁকজমকবর্জিত। প্রায় ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির কাউন্সিল হওয়ার কথা ব্যাপক ঘটা করে। উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু তা না করে কেন এরকম সীমিত আয়োজনের নির্দেশনা? এর কারণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশে ক্রমে ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ আগামী বছর সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছে। বলা হচ্ছে, ২০২৩ হবে দুর্ভিক্ষের বছর। ২০২০ সাল থেকেই বিশ্ব নানা সংকটে টালমাটাল। করোনা গোটা বিশ্বকে গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রায় নয় মাস ধরে চলছে এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইউরোপকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। আমাদের অর্থনীতির শক্তি এবং সামর্থ্যরে জায়গাগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রবাসী আয়ে কোনো সুখবর নেই। আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে অক্টোবরে। রপ্তানি আয়েও সুখবর নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সংকট শিল্পোৎপাদনকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। একমাত্র কৃষি ছাড়া কোথাও কোনো সুখবর নেই। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। চিহ্নিত অর্থ পাচারকারী, লুণ্ঠনকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। এত সংকটের মধ্যেও দুর্নীতি কমেনি। আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকটের কথা বলছেন। দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। বুধবার নবীন সরকারি কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। অনুরোধ করলেন কৃচ্ছ্রসাধনের। আহ্বান জানালেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না রাখার। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সংযম ও ব্যয় সংকোচের কথা বলছেন, তখন দুই আমলা শিরোমণির জন্য বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর অনৈতিক ও কুৎসিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। সেই প্রাসাদে সুইমিংপুলও থাকবে! দেশ যখন সংকটের উত্তাপে বিপন্ন তখন শিরোমণি আমলারা একটু সাঁতার বিনোদন করবেন না, তা কী করে হয়। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা আমলারা যখন নানা সুযোগ-সুবিধার থালা চেটেপুটে খাচ্ছেন, তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেবল বিএনপির সমালোচনার ভাঙা রেকর্ড অবিরত বাজিয়ে চলেছে। কিছু মন্ত্রী এবং নেতার বক্তব্য এখন গণবিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগে নানা জানা-অজানা রোগ বাসা বেঁধেছে। কিছু কিছু রোগ দুরারোগ্য ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদী হাইব্রিডরা যেন এখন আওয়ামী লীগকেই গ্রাস করে ফেলছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির কিছু ব্যক্তি যেন ভিনগ্রহ থেকে আসা এলিয়েন। এদের গাল সামান্য রোদে মাখনের মতো গলতে থাকে। তৃণমূলের বেশির ভাগ ত্যাগী-পরীক্ষিত কোণঠাসা। তাদের চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ। দলে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। কোন্দল, হানাহানি প্রায় সর্বত্র। টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি হচ্ছে। পদবাণিজ্য, কমিটি-বাণিজ্য আওয়ামী লীগে মহামারির আকার ধারণ করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলা পরিষদ সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ! এমপিদের অর্ধেকেরই এলাকার সঙ্গে সংশ্রব নেই। সারা দিন ব্যস্ত থাকেন নানা তদবিরে। চাকরি-বাণিজ্য, ত্রাণ নয়ছয়, কমিশন-বাণিজ্য এসব নিয়েই ব্যস্ত আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধেক সংসদ সদস্য। এরা যেন মনে করছেন, এবারই শেষ সুযোগ। যা বানানোর বানিয়ে নিই। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন সময়ের দাবি। দলের কয়েকজন নেতা নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব এড়াতে বিএনপিবিরোধী চটুল বক্তব্য রাখাটাই একমাত্র কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের কথার দাপটে মৃতপ্রায় বিএনপিও এখন জেগে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন সংকটের কথা বলছেন খোলামেলাভাবে, তখন কিছু মন্ত্রী সংকট আড়ালের লুকোচুরি খেলায় মেতেছেন। সবকিছু মিলিয়ে দল এবং সরকার কোনোটাই ভালো নেই। ২০০৯ সালে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ সময় বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সে উন্নয়নই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এক বছরের কিছু বেশি সময় আছে সংসদ নির্বাচনের। এর মধ্যে নানা অস্বস্তি, সমালোচনায় এলোমেলো আওয়ামী লীগ। এ রকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ তার জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

 

১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে। সেই কাউন্সিলে দল রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে নেতা নির্বাচিত করার কোনো বিকল্প ছিল না। সেই থেকে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। এ মুহূর্তেও তাঁর কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা একাই দলের হাল ধরে আছেন। একাই সব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এ দলটি মুমূর্ষু। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘একজন কাউন্সিলরও যদি না চায় তাহলে আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকব না।’ কাউন্সিলর তো দূরের কথা। একজন কর্মীও শেখ হাসিনার বিকল্পের কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। তাই আসন্ন কাউন্সিলে যে দলীয় প্রধান পদ নিয়ে কোনো আলোচনাই হবে না, তা বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আবেগ ও ভালোবাসা জড়িত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক যুগ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায়ই তিনি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে জনগণের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রথম সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। কারাগারে থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান নবগঠিত দলটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক অবশ্য সংগঠনের জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন দলটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের জাগরণের অধ্যায় শুরু হয়। মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতি শুরু থেকেই বাঙালির সমর্থন ও সহমর্মিতা ছিল। কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী করা, জনগণকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব যখনই কারাগারের বাইরে থেকেছেন, তখনই সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের প্রাণ ভোমরায় পরিণত হন তিনি। তরুণ সাহসীদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে এক উজ্জীবিত সংগঠনে পরিণত করেন। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্য হয়। কাগমারী সম্মেলনের পর মার্চে মওলানা ভাসানী দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে ভাসানীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। পদত্যাগ করলেও ভাসানীকেই আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বহাল রাখা হয়। কিন্তু এর কদিন পরই ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই ভাসানীর উদ্যোগে ঢাকায় গণতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে মুজিবের সংগঠন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। বন্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা। এ সভায় দল পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত হয়। তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিব হন সাধারণ সম্পাদক। এ ধারাবাহিকতায় মার্চের ৬ ও ৭ ঢাকার ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে তর্কবাগীশ সভাপতি হন। চতুর্থবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন ‘অসাধারণ’। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। বাঙালির স্বপ্নের সারথি। এর পরের ইতিহাস বাঙালির মুক্তির ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ’৭০-এর নির্বাচন। শেখ মুজিবই হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের আরেক নাম। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ছয় দফা অনুমোদিত হয়। ওই কাউন্সিলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর ও অসাধারণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন আরেক ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৬-এর ১৮ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন জনগণের নেতা। জনজাগরণের কাব্য। তাজউদ্দীন ছিলেন নিভৃত সংগঠক। গোছানো একজন নেতা। একজন জ্ঞানমনস্ক রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণতা দেওয়াই ছিল তাঁর আরাধ্য। ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন আরেক মহিরুহ এ এইচ এম কামারুজ্জামান। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের শেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৪ জুন। এ কাউন্সিলে দ্বিতীবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। আওয়ামী লীগের জন্য এ কাউন্সিল ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত নেতৃত্বই ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এনে দেন। এনে দেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ম্যান্ডেট। ’৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পরিকল্পনার নিখুঁত বাস্তবায়ন করেন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।

 

’৭০-এর ৪ জুনের কাউন্সিল যেমন আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবারের কাউন্সিলও তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছে। ’৭০-এর কাউন্সিলে তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে এক ঐতিহাসিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন তাজউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। তাজউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সংগঠনভাবনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায়। আমার বিবেচনায় ওই সময় যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্য কেউ হতেন তাহলে প্রবাসী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা অনেক দুরূহ হতো। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাঁরা সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তাঁরা সবাই ভালো নেতা। সদ্যপ্রয়াত বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। প্রত্যেকেই জাতীয় নেতা। আওয়ামী লীগের ত্যাগী সংগ্রামী নেতা। কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র দুজন ছাড়া কেউই ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠতে পারেননি। এদের কেউ কেউ সংকটে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেনে ক্ষুদ্র পরিসরে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। কিন্তু কাউন্সিল শুরুর আগেই আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। তীব্র কোন্দলের মুখে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ১০ দিনের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের। ১৯৭৮ সালের ৩ থেকে ৫ এপ্রিল সংকটাপন্ন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল করে। এ কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি হন। দক্ষ সংগঠক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় আবদুর রাজ্জাকের সামনে সুযোগ এসেছিল ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে ওঠার। কিন্তু সংকীর্ণ স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে যান আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুবিহীন আওয়ামী লীগ এক পথহারা বিভ্রান্ত বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। তৃণমূল থেকে আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে দরকার। এ সময় মুমূর্ষু আইসিইউতে থাকা আওয়ামী লীগকে বাঁচানোর আর কোনো বিকল্প ছিল না। ’৮১-এর কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয়। শেখ হাসিনা সভানেত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে জাগরণ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠনের সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধেন। ইতিহাসে অমর হওয়ার এক অনন্য সুযোগ এসেছিল দক্ষ সংগঠক আবদুর রাজ্জাকের সামনে। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারের পাশে বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে থাকার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছিলেন এই নেতা। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ, মাইম্যান নীতিতে আবদুর রাজ্জাক ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠতে পারেননি। শেখ হাসিনার পথ কঠিন করতে আবদুর রাজ্জাক উপদলীয় কোন্দলের পথে পা বাড়ান। তাঁর উদ্যোগে ১৯৮২ সালের ১ মে ছাত্রলীগ ভেঙে যায়। এ ধারায় আওয়ামী লীগ ভাঙনের মুখে পড়ে। ১৯৮৩ সালের ২২ অক্টোবর মহিউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করে বাকশাল গঠিত হয়। এ সময় আবার সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ক্রমে তিনি ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী প্রমাণ করেন নেতার প্রতি বিশ্বস্ত, আদর্শের প্রতি অনুগত থাকলে সংগঠন গড়ে তোলা যায়। নেতার আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সাজেদা চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দুঃসময়ের কাণ্ডারি। ’৮৭ সালের কাউন্সিলে যখন তিনি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হন, তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পর জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৯২-এর ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে। তিনিও ছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক। ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন না জিল্লুর রহমান। কিন্তু নেতার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততায় অনুকরণীয় নেতা হয়ে থাকবেন চিরকাল। আবদুল জলিলও বিশ্বস্ত ছিলেন। দলীয় সভানেত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন। কর্মীদের খোঁজখবর নিতেন। সংগঠনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু কঠিন সময়ে সংকটে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের ধাক্কায় হতবিহ্বল জলিল রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেন। একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি আওয়ামী লীগের এই পোড় খাওয়া নেতা। আবার কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগে না থাকার পরও ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন সময়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য ‘মাইনাস ফরমুলা’ আবিষ্কার হয়। মাইনাস ফরমুলা বাস্তবায়নের জন্য গ্রেফতার করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে। ’৭০-এ বঙ্গবন্ধু যেমন তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও তেমনি গ্রেফতারের আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ রেখেছিলেন। প্রচারবিমুখ, কর্মীদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা সৈয়দ আশরাফ সংকটে ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সৈয়দ আশরাফ নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। খুব বেশি কথা বলতেন না। কিন্তু যখন কথা বলতেন যখন মূল্যবান কথাই বলতেন। প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে যা খুশি বয়ান দিয়ে নিজেকে খেলো করতেন না। তাঁর কথা জনগণ বিশ্বাস করত, পছন্দ করত। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় তার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কী শক্তিশালী, কী দৃঢ় সেই বক্তব্য। গোটা দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছিল ওই কথায়। সৈয়দ আশরাফ প্রমাণ করেছেন সাধারণ সম্পাদকের কাজ প্রতিদিন কাগজ দেখে একই কথা বারবার বলা নয়। সাধারণ সম্পাদককে বিশ্বস্ততার প্রতীক হতে হবে। তার কথাবার্তা হতে হবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এবার কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের চাওয়া একটাই- একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক। যিনি নেতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন। আদর্শে থাকবেন অবিচল। সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কর্মীদের সুখ-দুঃখ দেখবেন। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের পাশে দাঁড়াবেন। দলের কাজ করবেন দিনরাত। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এমন নেতা আওয়ামী লীগে আছে। সামনে কঠিন সময়। এ সময় এ রকম একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]     সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com